সারাদেশ
সাহসিনীর একটি বিদ্রোহের ফসল পদ্মা সেতু ।। মোল্লা তানিয়া ইসলাম তমা ।।
সবকিছু মিলিয়ে এটি ঔপনিবেশিক স্থাপত্য শৈলীর এক অপূর্ব নিদর্শন একটি সেতু দিয়ে ২০২২ সাল থেকে পদ্মা নদী পারাপারের অধিকার অর্জন করেছে বাঙালি জাতি । “...ভূলোক দ্যুলোক গোলক ভেদিয়া খোদার আসন ‘আরশ’ ছেদিয়া, উঠিয়াছি চির-বিস্ময় আমি বিশ্ব বিধাতৃর!” বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম এর কবিতার বক্তব্যের মতো চির বিস্ময় নিয়ে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে আমাদের স্বপ্নের সেতু 'পদ্মা সেতু'। ইস্পাত নির্মিত কাঠামোটি তার কঠিন অবয়বকে অতিক্রম করে হয়ে উঠেছে ১৮ কোটি মানুষের আবেগ । যা ইতিহাসের অংশ হলেও মূলত একটি বিদ্রোহের ফসল । পুঁজিবাদের দেশি-বিদেশি অর্থনৈতিক প্রভু ও আন্তর্জাতিক পুঁজির তাঁবেদার শ্রেণীর বিরুদ্ধে এই বিদ্রোহ করেছিলেন শেখ হাসিনা । গুটি কয় অসাধু মানুষ ছাড়া বাংলাদেশের সকল মানুষ শেখ হাসিনার একক নেতৃত্বের এই বিদ্রোহে সামিল হয়েছিলেন। কেউ তাঁকে টলাতে পারেনি, এমনকি সাজানো, উদ্দেশ্যমূলক, মিথ্যা কলঙ্কও দিয়েও নয়। পঞ্চাশ বছর আগে সশস্ত্র যুদ্ধে স্বাধীনতা অর্জন করা এই সার্বভৌম বাংলাদেশ একবিংশ শতাব্দীতে এসে যখন ইতিবাচক উন্নয়ন চক্রের আসনে কেবল বসেছে তখন একটি মিথ্যা কলঙ্কের বোঝা খোদ বিশ্ব ব্যাংক চাপিয়ে দিল সে দেশের প্রধানমন্ত্রী যিনি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর কন্যা, তাঁর পরিবারের নানা স্তরের সদস্য, তাঁর সরকারের সহায়ক নানা পর্যায়ের পারিষদবর্গের বিরুদ্ধে। কোন অভিযোগ শেষ পর্যন্ত তারা প্রমাণ করতে পারেনি এমনকি আদালতে যেয়েও অভিযোগের মামলা খারিজের দায় নিয়ে সটকে পড়েছে, কিন্তু সাহসিনী বিদ্রোহী শেখ হাসিনা ছেড়ে দেননি। দুর্মুখের মুখে এঁটে দিয়েছেন পরাজয়ের কলঙ্ক টিকা, যা পরাজিত পুঁজিবাদী সমাজের নিয়ন্ত্রকদের যুগ যুগ ধরে বহন করে যেতে হবে ও আর কোনদিন তা মুছে ফেলার ক্ষমতাও তাদের হাতে ফিরে আসার সুযোগ নেই। কারণ ‘বিদ্রোহী শেখ হাসিনা’ তাঁর দেশের সকল মানুষদের ঐক্যবদ্ধ ও উদ্বুদ্ধ করে কারো কাছে হাত না পেতে নিজের দেশের টাকায় ‘পদ্মা সেতু’ গড়ে ফেলেছেন। ষাটের দশকে বঙ্গবন্ধুকে একই রকম পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে যেতে হয়েছে। সারা দুনিয়ার মোড়লেরা মিলেও তাঁকে থামাতে পারেনি। বাংলার ‘দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটাবার ব্রত’ একটি আন্তর্জাতিক অন্যায় হয়ে গেল! জেল-জুলুম আর একই রকম মিথ্যা কলঙ্ক, কী করে নাই সে চক্র? কিন্তু বঙ্গবন্ধুর অবিচল একক নেতৃত্বে ঐক্যবদ্ধ বাঙালি জাতি অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করে হলেও নিজের স্বাধিকার অর্জন করে নিজেই দেশ পরিচালনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে- সে অপমান আর পরাজয় বিরুদ্ধবাদী সমাজের এখনও বয়ে বেড়াতে হচ্ছে। ফলে পদ্মা সেতু যখন অনিবার্য প্রকল্প হলো তখন পরাজিত দেশি- বিদেশি সেই ‘পুরনো শকুনেরা’ সুযোগ নিতে চাইলো। পুঁজিবাদী সেইসব বিশ্ব মোড়লেরাই বাংলাদেশের বিরুদ্ধে আবার এক হয়ে গেল কিন্তু সাহসিনীর নেতৃত্বের কাছে পরাস্ত হলো। ২৫ জুন ২০২২ বাংলাদেশের মানুষ মাতৃসমা পদ্মা নদীর বক্ষ চিরে ঠাই দেয়া সেতু পারাপারের অধিকার অর্জনের স্বাধীনতা উপভোগ করবে। বাংলাদেশ এখন শেখ হাসিনার নেতৃত্বে একটি উন্নয়ন পরিসীমা অর্জনের ক্রান্তিলগ্ন পার করছে। ২০০৯ সালে ক্ষমতায় আসার পরেই এই লক্ষ্য অর্জনের সফল প্রক্রিয়া শুরু হয়। সহস্রাব্দের উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (মিলেনিয়াম ডেভেলপমেন্ট গোলস বা এমডিজি) অর্জনে বাংলাদেশ যথেষ্ট পরিমাণ সক্ষমতার পরিচয় দিতে শুরু করে। ২০১৫ সালে এমডিজি সূচক মূল্যায়ন করে পরের ধাপে এসডিজি- সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট গোলস বা টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা মাত্রা অর্জনেও ২০৩০ সালের মধ্যে বাংলাদেশ যে ভালো করবে সেসবের লক্ষণ নিয়ে বিশ্ব মোড়লদের হিসাব নিকাশ চলছিল। এর সাথে ছিল রাজনৈতিক-অর্থনীতিতে কেমন করে বাংলাদেশকে পদানত করে রাখা যায় সে সবের হিসাবও। কারণ বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার, রায় কার্যকর, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ও রায় কার্যকর করে বাংলাদেশের রাজনীতিকে একটি বিশুদ্ধকরণ প্রক্রিয়ায় নিয়ে যাওয়া হবে, বিরুদ্ধবাদী অক্ষ শক্তি ২০০৯ সালেই তা টের পেয়েছিল। ফলে শেখ হাসিনার সরকার ক্ষমতায় আসার পর পরই নানারকম ষড়যন্ত্র শুরু হয়, তীরবিদ্ধ করার প্রক্রিয়া শুরু হয় প্রথমে শেখ হাসিনার ঘর থেকেই, পরিবারের সদস্য ও আত্মীয়-স্বজনদের জড়িয়ে নানারকম মিথ্যাচার করে শেখ হাসিনার মনোবল দুর্বল করার চেষ্টা করা হয়। এরা জানে এই পরিবারের শক্তি সম্পর্কে তাই তাঁদের দুর্বল করার উদ্যোগ নিয়ে একে একে মন্ত্রী পরিষদের কোন কোন সদস্য, প্রশাসনের নিবেদিতপ্রাণ অফিসারদের ও উপদেষ্টা পরিষদের সদস্যদের বিরুদ্ধে মিথ্যাচার করে তাঁদের সর্বোপরি পুরো সরকারের মনোবলই দুর্বল করার চেষ্টা করা হয়। ইতিহাসের অংশ হিসেবে বাংলাদেশের মানুষকে মনে রাখতে হবে এই বাংলাদেশের অভ্যুদয় সংগ্রামের সাথে অবিচ্ছেদ্যভাবে জড়িয়ে আছে বঙ্গবন্ধু পরিবার। মুক্তিযুদ্ধে এদের অংশগ্রহণ ও ত্যাগের বিবরণ অনুসরণীয়। বাঙালি মাত্রেই জানেন ১৯৭৫ সালের নির্মম পৈশাচিকতায় বঙ্গবন্ধু পরিবারেরই ১৯জন সদস্যকে জীবন দিতে হয়েছিল। নানা সময়ে জেল-জুলুম-অত্যাচার সহ্য করার কাহিনী সুবিদিত। এই পরিবারের শক্তিকে ভয় পাবার প্রধান কারণ বঙ্গবন্ধু ও তাঁর কন্যা শেখ হাসিনা, যারা দুই পর্বে এই দেশের স্বাধীনতা ও স্বাধীনতার সুফল দেশের মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে প্রতিশ্রুত ও তা বাস্তবায়ন করেছেন। নেতৃত্ব শক্তিকে পৈশাচিক প্রক্রিয়ায় ধ্বংস করতে পারার প্রবৃত্তি থেকে মুক্ত থাকা কোন কালেই ইতিহাসে ছিল না । মানুষের মুক্তির সংগ্রামের এই দুই দিশারীর পরিবারকে কলঙ্কিত ও নির্মূল করার এই প্রচেষ্টা খুবই সুপরিকল্পিত ছিল যা ‘৭৫ সালের ঘটনাবলীর সাথে মিলে যায় । অপরদিকে শেখ হাসিনার উপদেষ্টা পরিষদের একজন সুপরিচিত, সৎ ও নির্মল ব্যক্তিত্বের অধিকারী ড. মসিউর রহমান সততার শর্ত ভঙ্গ করেছেন মর্মে নানারকম কলঙ্ক চাপিয়ে দেবার চেষ্টা হলো খোদ বিশ্ব ব্যাংক থেকেই আর এতে যোগ দিল দেশের ভেতরের অক্ষ শক্তির কিছু তাঁবেদার তথাকথিত সুশীল সমাজ । ভুল যুক্তির ফলে বলি দেয়া হল একজন মন্ত্রী ও সেতু বিভাগের সচিবকে। কিন্তু অটল শেখ হাসিনা কি তাঁর বিদ্রোহে সামান্য বিরতি দিয়েছেন? দেননি, আর সে কারণেই দেশ-বিদেশের সকল নেতিবাচক প্রচেষ্টা, উদ্যোগ ব্যর্থ হয়, পদ্মা সেতু আলোর মুখ দেখেছে । ভারতবর্ষের, এমনকি বিশ্ব ইতিহাসে অন্যায়ের বিরুদ্ধে যতগুলো বিদ্রোহের ঘটনা লিপিবদ্ধ আছে, শেখ হাসিনার এই বিদ্রোহের কথাও সেখানে লিখিত থাকবে। সে বিদ্রোহের ইতিহাস পাঠ করে জগতের মানুষ চিরকাল ন্যায়ের পক্ষে থাকার অনুপ্রেরণা পাবে । এদিকে বাংলাদেশের অর্জন বিশ্ব আজ স্বীকার করেছে । দূরদর্শী নেতৃত্বের কারণে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নোবেল পুরস্কার পেতেই পারেন বলে আশা প্রকাশ করেছেন বিজ্ঞজনেরা ।
Comments