সারাদেশ

গাইবান্ধায় পুলিশ ও আসামির ছেলের ঘুষ লেনদেনের ফোনালাপ ফাঁসে তোলপাড়

গাইবান্ধা ঃ গাইবান্ধায় আওয়ামী লীগ নেতার বাসায় নিহত জুতা ব্যবসায়ী হাসান আলী (৪৫) হত্যা মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা তৎকালীন গাইবান্ধা ডিবি পুলিশের ওসি ও বর্তমানে সুন্দরগঞ্জ থানার ওসি মো. তৌহিদুজ্জামান সঙ্গে এক আসামির ছেলের ঘুষ লেনদেনের পাঁচটি ফোনালাপ ফাঁস হয়েছে। কয়েকটি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও ফোনালাপগুলো ভাইরাল হয়েছে। এ নিয়ে জেলার সর্বত্র আলোচনা-সমালোচনা চলছে। শুরু হয়েছে তোলপাড়।

তবে এ বিষয়ে গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জ থানার ওসি মো. তৌহিদুজ্জামান আসামির নাম বাদ দেওয়ার কথা বলে টাকা নেওয়ার অভিযোগ অস্বীকার করেন। তিনি বলেন, অভিযোগটি সঠিক নয়। এটা অসম্ভব। এটা চাঞ্চল্যকর মামলা তাই টাকা নেওয়ার প্রশ্নই আসে না। টাকা লেনদেনের প্রমাণ আছে বিষয়টি জানালে ওসি বলেন, টাকা লেনদেন নিয়ে তার কারো সাথে কোনো কথাবার্তা হয়নি। এছাড়া তিনি কোনো আসামির নাম বাদ দেননি বলেও দাবি করেন। প্রায় ১৭ মিনিটের পাঁচটি কল রেকর্ড এসেছে । সেই কল রেকর্ডে বলতে শোনা যায়-
প্রথম কল রেকর্ডে
আসামির স্বজন : আসসালামু আলাইকুম স্যার, এই যে বিষয়টা আমি... জানাইলাম, বুঝছেন। তা উনি তো আসতে পারবে না। উনি ওনার।
পুলিশ : যেদিন আসতে পারবে, সেই দিন আসবে। সমস্যা নাই।
আসামীর স্বজন : না না উনি বলতিছে। উনি কি বলতিছে উনি বলতিছে যে, উনি তো বলছে যে কাজ না হলে টাকা ফেরত দিয়ে দিবে। তা উনি এখন টাকা ফেরত।
পুলিশ : আমি ওনার সাথেই কথা বলবো।
আসামীর স্বজন : উনি আপনার সাথে ফোনে কথা বলতে চাচ্ছে। স্যার, উনি আপনার সাথে ফোনে কথা বলতে চাচ্ছে।
পুলিশ : হোয়াটসঅ্যাপে ফোন দিতে বলো, হোয়াটসঅ্যাপে কল দিতে বলো।
আসামির স্বজন : ওনাকে বলবো হোয়াটসঅ্যাপে কথা বলতে।
পুলিশ : হ্যাঁ, হোয়াটসঅ্যাপে হোয়াটসঅ্যাপে কল দিতে বলো।
আসামির স্বজন : আচ্ছা, ওনাকে তাহলে এই নাম্বারটা দিয়ে দিচ্ছি যে, হোয়াটসঅ্যাপে আপনি ফোন দিয়েন। আচ্ছা ঠিক আছে স্যার।

দ্বিতীয় কল রেকর্ডে  
পুলিশ : তোমাদের আমি কি, তোমারে যা মনে করছিলাম, তুমি তো পুরা পুরা পুরা চেঞ্জ করে ফেলাইলা চেহারা।
আসামির স্বজন : স্যার আমি এখন স্যার কী বলবো আপনিই বলেন। আমাক কী এখন।
পুলিশ : (অস্পষ্ট) শোনো তোমার তো একজন আসামি তো টোটালি ওটা তো নেওয়াই হয়েছে একজন আসামির জন্য। একজন আসামি বাদ দিলে এইটা ব্যাপারে তো কথা না, কথা হলো মূল ধারা বাদ দিয়ে দেব। এইটা হলো মূল। ওর নামে দিছি ছয়টা ধারা আর তোমাগো নামে দেব দুইটা।
আসামির স্বজন : সেইটা তো স্যার আমি তো স্যার বুঝছি। একন এইযে বাসায় আইসা এখন।
পুলিশ : (অস্পষ্ট) তোমাদেরকে আমি কোনো ডিস্টার্ব করবো না।
আসামীর স্বজন : হ্যাঁ হ্যাঁ ওটা চাচ্ছি না আমরা। ওটা সমস্যা না।
পুলিশ : (অস্পষ্ট) আর তোমার যে মেইন আমি কাজ করে দিলাম। তোমার এতোকিছু ফোনে কথা বলবো না। তুমি যেদিনই আসো তুমি আমারে একটা ফোন দিয়ে তোমার ওই ... নিয়ে আসো।
আসামির স্বজন : এখন স্যার ঠিকই আছে, আপনার কথা ঠিকই আছে, এখন এনাদের ভাষ্যটা কী, আমি এখন স্যার বিপদে। এনাদের ভাষ্য হচ্ছে।
পুলিশ : বিপদের বিপদ নাই। আমি বিপদ উদ্ধার করে দেব, শ্যাস। (অস্পষ্ট কিছু কথা)।
আসামির স্বজন : সেটা ঠিক আছে। আব্বুর শ্বশুর।
পুলিশ : কথাটা শোনো আগে, কথাটা শোনো আগে।
আসামির স্বজন : বলেন বলেন।
পুলিশ : তোমার কোনো বিপদ নাই। আগে আমি কাজ করে নেই, কাজ করতে আরও ১০ ১২ দিন লাগবে, তারপর তুমি তোমার (অস্পষ্ট) নিয়ে আসবা। আগে কাজ আমি রেডি করি। তোমার (অস্পষ্ট) নিয়ে আসার পরে (অস্পষ্ট) তারপর কথা বলবো। ক্লিয়ার।
আসামির স্বজন : সেটা তো ক্লিয়ার স্যার আমার একটা কথা শোনেন, এনাদের এখন মানে।
পুলিশ : ওনার মাধ্যমেই হয়েছে। যা বলবো ওনার মাধ্যমেই বলবো। তুমি মাঝখানে ওনাকে নিয়ে আসছিলা সব ব্যাপারে।
 
তৃতীয় কল রেকর্ডে
পুলিশ : তিন চার ডেটে খালাস হবে। খালাস না হলে তখন আমার কাছ থেকে পুরোটা নিয়ে যাইও, ঠিক আছে। আমার কাছে রইলো তোমাদের আমানত।
আসামির স্বজন : সেইটা ঠিক আছে। আমি এখন বেকায়দায় পড়ে গেছি। আমি তো হলাম মাধ্যম। আমাক ধরছে ঠিকমতো। এখন তুই ওনার থেকে কিভাবে নিয়ে আসবি নিয়ে আয়। আমি তো এখন স্যার বিপদে। গালিগালাজও শুনছি।

চতুর্থ কল রেকর্ডে
পুলিশ : তোমার শ্বশুরের এইটা মাত্র দুইজন সাক্ষীর মাধ্যমে দিয়া শেষ করে ফেলাবো।
আসামির স্বজন : ওনারা এখন বলতিছে যে, যেহেতু স্যারেক আমরা প্রথম অ্যামাউন্ট দিছিলাম ওটা আমাদের দরকার নাই। পরে বাকি যে যেটা দিছি আমরা সাত লাখ টাকা, এটা পুরাটাই চাচ্ছে।
পুলিশ : তাহলে আমি ওই ধারাধুরা যা আছে সব দিয়ে দেব। ঠিক আছে নিয়ে যাও।
আসামির স্বজন : ওনারা বলতিছে যে, নাম না থাকার জন্য টাকা দিলাম। সেই নাম থাকতিইছে। তাই এখন আমার উপরে চাপ দিতেছে যে, তুই স্যারেক বল যে টাকাটা দিয়ে দিক।
পুলিশ : আমার সরলতার সুযোগ নিচ্ছে আরকি তাইতো। তবে ওইটা হবে না।
আসামির স্বজন : কোনটা।
পুলিশ : তুমি যেটা এইমাত্র বললা, ওটা প্রশ্নই আসে না। আকাশ-পাতাল চেঞ্জ করে দিছি আমি।

পঞ্চম কল রেকর্ডে
আসামির স্বজন : যেহেতু টাকাটা আমার হাত দিয়ে দিছি। আপনি টাকাটা আমাদেরকে কোনদিন দেবেন, সেটা বলেন।
পুলিশ : তুমি পুরা রেকর্ড করার জন্য ফোন দিছো।
আসামীর স্বজন : রেকর্ড করার জন্য ফোন দেই নাই স্যার। রেকর্ড করলে তো আগেই করতে পারতাম। বাড়ির লোকজন বলতিছে যদি টাকা না ওঠে এসপি, ডিআইজি, আইজি সব স্যারের কাছেই যাবে।
পুলিশ : হেসে হেসে এ ব্যাটা, আমারে ওই ভয় দেখাইয়া লাভ আছে।
আসামির স্বজন : আপনি তো বলছেন যে, কাজ না হলে টাকা ফেরত দিবেন।
পুলিশ : হ্যাঁ, অবশ্যই। এখনও তো আমি স্বীকার আছি। অবশ্যই দেব ফেরত।
আসামির স্বজন : আমাদের টাকাটা আপনি দিয়ে দেন।
পুলিশ : তুমি আসো, এসে সামনাসামনি কথা বলো।
আসামির স্বজন : ওখানে যাওয়া যাবে না স্যার।

ওই কল রেকর্ডে আরও কিছু সময় কথা হয় ওই পুলিশ কর্মকর্তার সাথে। যেখানে ওই পুলিশ কর্মকর্তা রোববার থেকে বৃহস্পতিবারের যেকোনো দিন বসার কথা বলেন। কেননা তাকে ব্যাংক থেকে টাকা তুলতে হবে আর ভুক্তভোগীরা তৃতীয় একটি জায়গায় বসার প্রস্তাব দেন। পরে সাত লাখ টাকা ফেরত দেন ওসি মো. তৌহিদুজ্জামান।

গত বছরের ১০ এপ্রিল সকালে আওয়ামী লীগ নেতা মাসুদ রানার (৪২) বাসা থেকে হাসানের লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। গাইবান্ধা সদর উপজেলার নারায়নপুর এলাকার মাসুদের বাসা। তিনি গাইবান্ধা জেলা আওয়ামী লীগের বহিস্কৃত উপ-দপ্তর সম্পাদক। ঘটনার পর দল থেকে তাকে বহিষ্কার করা হয়।

মাসুদ রানা একজন দাদন ব্যবসায়ী। দলীয় পরিচয় ব্যবহার করে দাদন ব্যবসা করতেন। প্রায় দুই বছর আগে রানার কাছ থেকে পাঁচ লাখ টাকা ঋণ নেন শহরের স্টেশন রোডের জুতা ব্যবসায়ী হাসান আলী। এই টাকা সুদে-আসলে ১৯ লাখে দাঁড়ায়। সুদের টাকা দিতে না পারায় গত ৬ মার্চ লালমনিরহাট থেকে হাসানকে মোটরসাইকেলে তুলে আনেন মাসুদ রানা। তিনি হাসানকে নিজ বাসায় এক মাসের বেশি আটকে রেখেছিলেন। এনিয়ে নিহতের স্ত্রী বিথী বেগম সদর থানায় মাসুদ রানাসহ তিনজনকে আসামি করে হত্যা মামলা দায়ের করেন। অপর দুইজন হচ্ছেন শহরের স্টেশন রোডের জুতা ব্যবসায়ী রুমেল হক ও খলিলুর রহমান।

প্রথমে মামলার তদন্ত করেন গাইবান্ধা সদর থানার তৎকালীন পরিদর্শক (অপারেশন) সেরাজুল ইসলাম। পরে গাইবান্ধা ডিবি পুলিশের তৎকালীন ওসি, বর্তমানে সুন্দরগঞ্জের কঞ্চিবাড়ী পুলিশ তদন্ত কেন্দ্রের উপ-পরিদর্শক মানষ রঞ্জন দাস দায়িত্ব পান। সর্বশেষ মামলার তদন্তকারি কর্মকর্তার দায়িত্ব পান গাইবান্ধা ডিবি পুলিশের ওসি ও বর্তমানে সুন্দরগঞ্জ থানার ওসি মো. তৌহিদুজ্জামান। হাসান আলীর (৪৫) লাশ উদ্ধারের ঘটনার নয় মাস ৬ দিন পর গত ১৬ জানুয়ারি আইও (তদন্তকারি কর্মকর্তা) আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করেন। ফেব্রুয়ারির শেষের দিকে তা সংশোধনের জন্য তদন্তকারি কর্মকর্তার কাছে ফেরত পাঠানো হয়।

এদিকে ঘটনার বিচারের দাবিতে ব্যবসায়ী ‘হাসান হত্যার প্রতিবাদ মঞ্চ’ গড়ে ওঠে। বিচারের দাবিতে দুই মাসব্যাপী আন্দোলন চলে। আন্দোলনের মুখে সদর থানার তৎকালীন ওসি মাহফুজার রহমান, পরিদর্শক (তদন্ত) মজিবর রহমান এবং উপ-পরিদর্শক মোশারফ হোসেনকে অন্যত্র বদলি করা হয়। ঘটনার দিনই মাসুদ রানাকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। তিনি বর্তমানে জেলা কারাগারে রয়েছেন।

Jamie Belcher

info@jagobahe24.com

News portal manager

Follow Me:

Comments