সারাদেশ

কোরবানির সময় গরুর গোস্ত খাইছু

জসীমউদ্দীন ইতি, ঠাকুরগাঁও প্রতিনিধিঃ দ্রব্যমূল্যের পাগলা ঘোড়া ছুটেছে বিরামহীন। তাকে চাবুক মারার উপায় তো নেই, বরং তার চাবুকের কষাঘাতে ক্ষত-বিক্ষত নিম্ন ও মধ্যম আয়ের মানুষ। মাছ-মাংস দূরের কথা, কোনো রকমে উদরপূর্তি করতেই নাভিশ্বাস উঠছে শ্রমজীবীদের। শিক্ষা, চিকিৎসাসহ অন্যান্য চাহিদা পূরণের সব উপায় বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। ছেলেমেয়ের মুখে দুমুঠো ভাত তুলে দিতেই হিমশিম অবস্থার কথা জানালেন ঠাকুরগাঁওয়ের বালিয়াডাঙ্গীর আমজানখোর ইউনিয়নের একদল শ্রমিক।

সকাল থেকে মাঠে কাজ করছেন জোনাকি-ফাতেমাসহ ছয় শতাধিক শ্রমিক। দুপুরের তারা দলবেঁধে একসঙ্গে খাবার খান। তবে তাদের দলবেঁধে খাওয়া দেখে দূর থেকেই যে কারো মনে হবে তারা বনভোজন করছেন। কাছে গিয়ে দেখা যায় এটা কোনো বনভোজন নয়, সকাল থেকে কাজ করে তারা দলবেঁধে এভাবেই গল্পে গল্পে আহার করছেন।

বালিয়াডাঙ্গী উপজেলার আমজানখোর ইউনিয়নের সীমান্ত এলাকায় রাস্তা নির্মাণের কাজ করছিলেন একদল শ্রমিক। দুপুরে কাজের বিরতির পর একসঙ্গে গাছতলা বসে খাবার খাচ্ছিলেন তারা।

কথা হয় জোনাকি রানীর সঙ্গে। তিনি  বলেন, সকাল থেইক্কা বিকাল পর্যন্ত কাম কইরা ৩০০ টাকা কামাই করি। সেই কামাই দিয়া নিজে খাই, ছুয়া দু'ডাক খাওয়াই-পড়াই। মোর কী আর পিকনিক যাবার ক্ষমতা আছে রে বাপু। চাইলের যে দাম, মাছ, মাংস, তেলের দাম বাড়ছে। কয়দিন পর ক্যামনে ছুয়াডাক নিয়া চলমু, কী খাম হেয় চিন্তায় বাঁচুনা, তোমরা কহেচেন পিকনিক করছেন নাকি, হামার এডাই পিকনিক। ডাল-ভাত, শাক-ভাত দিয়া এক-লগে বসে সবদিন হামরা ভাত খাই। পয়সা খরচ কইরা গাড়িতে চইড়া কি পিকনিক করার সাধ্য হামার আছে? গরিবের দুঃখ দেখার কেহ নাই। হামাক সবাই ব্যবহার করে।

জোনাকির বাড়ি ঠাকুরগাঁওয়ের বালিয়াডাঙ্গী উপজেলার বড়বাড়ী ইউনিয়নের আধাদিঘী গ্রামে। রাস্তা নির্মাণকাজে শ্রমিক হিসেবে ৩০০ মজুরিতে কাজ করেন তিনি। বাড়িতে রয়েছেন দুই মেয়ে। তার রোজগারেই চলে সংসার। স্বামী ছেড়ে গেছেন কয়েক বছর আগেই।

জোনাকি আপেক্ষ নিয়ে আরও বলেন, আগে ২৫০ টাকায় কাম করছিনু। এই টাকাই সংসারটা ভালো চলেছিল। এলা ৩০০ টাকা পাহানেও কোনো লাভ হয় না। বেগুনের কেজি ৬০ টাকা, আলুর কেজি ৩৫ টাকা, শাকের আটি ১০ টাকা। মাছ-মাংসের বাজারে গেলে নিজেরে দুর্ভাগা মনে হয়। চার মাস হইল মাছ-গোস্ত খাবা পারুনা।

জোনাকির কথা শেষ হতে না হতেই পাশ থেকে ফাতেমা বেগম বলে উঠেন, কোরবানির সময় গরুর গোস্ত খাইছু। বছর ঘুরে কোরবানি ঈদ না এলে মনে হয় গোস্ত খাবা পারিমনি। সারা দিন রোদে কাম করে যে টাকা পাও ওই টাকা দেহেনে আধা কেজি গোস্ত কেনা যায় না। এর পরে তেল, লবণ মসলা, পেঁয়াজ। এগুলো কিনতে আরেকদিন কাম করা লাগবে।

কথা হয় শ্রমিকের দলের সর্দার ফজলুল হকের সঙ্গে। তিনি বলেন, হামার দুঃখ কি দেখার কেউ আছে? বাজারের ব্যাগটা হাতে ধরে গেলে বাজারে যেতে ভয় লাগে। মোর তিনডা ছুয়া ভালো তরকারি না হলে ভাত খাবা চাহে না। সারাদিন যা পাছু তা দেহেনি কি আর ভালোমন্দ কিনিবা পারু না?

জোনাকি, ফাতেমা ও ফজলুল হকের মতো তাদের সঙ্গে রাস্তার নির্মাণকাজ করা প্রায় সব শ্রমিকের একই অবস্থা।

সকাল ৯টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত কাজ করে পুরুষেরা মজুরি পান ৫০০ টাকা আর নারীরা পান ৩০০ টাকা। এদের অনেকেই অভাবে মাছ-মাংস তো খেতেই পারেন না, উপরন্তু শাক-সবজির দামও আকাশচুম্বী। ক্ষুধা মেটানোয় দায় হয়ে পড়েছে।

ঠিকাদার রফিকুল ইসলাম  জানান, বালিয়াডাঙ্গী উপজেলার ৬ শতাধিক নারী-পুরুষ শ্রমিক রাস্তা নির্মাণের কাজ করে। এলাকায় যখন কাজ হয়, তখন কিছুটা শান্তিতে কাজ করতে পারেন এবং উপার্জন থেকে সঞ্চয় করতে পারেন। অন্য এলাকায় গিয়ে যখন কাজ করতে হয়, তখন সেখানে গিয়ে থাকা, ভাড়া ও খাওয়া খরচ বহন করতে গিয়ে সব শেষ হয়ে যায়। বর্তমানে নির্মাণ সামগ্রীর মূল্যবৃদ্ধির কারণে ইচ্ছে থাকলেও তাদের পারিশ্রমিক বাড়াতে পারছি না।


Jamie Belcher

info@jagobahe24.com

News portal manager

Follow Me:

Comments