September 19, 2024
সারাদেশ

স্মরণের আবরণে- সাহারা খাতুন ।। মোল্লা তানিয়া ইসলাম তমা ।।

ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন আর একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের প্রতিশ্রুতি দিয়ে জনগণের বিপুল ম্যান্ডেড নিয়ে ক্ষমতায় এসেছিল আওয়ামী লীগ । ক্ষমতায় এসেই সরকার গঠনেও ব্যাপক চমক দেখান বঙ্গবন্ধুকন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনা । স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মতো অত্যন্ত গুরুদায়িত্ব তুলে দেন বিশিষ্ট আইনজীবী এডঃ সাহারা খাতুনের কাঁধে । আর তিনিই হয়েছিলেন বাংলাদেশের প্রথম নারী স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী । দক্ষতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেছেন ২০১২ সাল পর্যন্ত । ওই সময় মন্ত্রণালয়ের রদবদল হলে নতুন দায়িত্ব পান ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের । সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুনের জন্ম ১৯৪৩ সালের পয়লা মার্চ, রাজধানীর কুর্মিটোলা এলাকায় । তার বাবার নাম আব্দুল আজিজ ও মায়ের নাম টুরজান নেসা । সাহারা খাতুন ছিলেন আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য, বাংলাদেশ আওয়ামী আইনজীবী পরিষদের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি এবং বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন । এছাড়াও তিনি আন্তর্জাতিক মহিলা আইনজীবী সমিতি ও আন্তর্জাতিক মহিলা জোটের সদস্য । ঢাকা-১৮ আসনের এই সংসদ সদস্য দায়িত্ব পালন করেছেন আওয়ামী লীগের আইন বিষয়ক সম্পাদকেরও । রাজপথ থেকে জাতীয় সংসদ: রাজপথের এই লড়াকু সৈনিক দেশের প্রতিটি আন্দোলন-সংগ্রামে ছিলেন সামনের কাতারে । সিদ্ধেশ্বরী গার্লস হাইস্কুল থেকে ১৯৬০ সালে ইস্ট-পাকিস্তান বোর্ডের অধীনে ম্যাট্রিকুলেশন, সিটি নাইট কলেজে থেকে ইন্টারমিডিয়েট পাস করেন । করাচি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি বিভাগে বিএ (ডিগ্রি) অর্জন করেন । ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগে ভর্তি হলেও তিনি কোর্স শেষ করেননি । ১৯৭৫ পরবর্তী সময়ে সেন্ট্রাল ল’কলেজ থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে দ্বিতীয় শ্রেণিতে এলএলবি ডিগ্রি অর্জন করেন। ছাত্র জীবনেই রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন তিনি । ১৯৬৭ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আইনের ছাত্রদের মধ্যে একটি নির্বাচনে তিনি ছাত্রলীগের প্রার্থী হিসেবে জয়লাভ করেন । সেটি ছিল তার জীবনের প্রথম নির্বাচন । ১৯৬৯ সালে আওয়ামী লীগের মহিলা শাখা যুক্ত হন । মহান একাত্তরের ২ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে জাতীয় পতাকা উত্তোলনের দিনেও তিনি ছিলেন সামনের সারিতেই । ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণের সময় সোহরাওয়ার্দী উদ্যানেও ছিলেন সামনের সারিতেই । ১৯৮১ সালে সুপ্রিম কোর্টে একজন আইনজীবী হিসেবে তার কর্মজীবন শুরু । প্রতিষ্ঠা করেন আওয়ামী আইনজীবী পরিষদ । রাজপথে আন্দোলনের জন্য তাকে কারাগারেও যেতে হয়েছে বহুবার । ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ইতিহাসের নির্মম হত্যাকা-ের পর আওয়ামী লীগের অন্য অনেক নেতাকর্মীর সঙ্গে গ্রেপ্তার করা হয় সাহারা খাতুনকেও । ওইসময় দীর্ঘ আড়াই বছর কারাগারে ছিলেন তিনি । পরে সাহারা খাতুন আবারো গ্রেপ্তার হন বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে । বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্নেহধন্য সাহারা খাতুন কল্যাণমূলক রাজনীতির কারণে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার অত্যন্ত প্রিয়ভাজন ছিলেন । ওয়ান-ইলেভেনের সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় সাহারা খাতুন নিজেও রাজনৈতিক অপরাধে অভিযুক্ত হয়েছিলেন । রাজপথ, কারাগারের রোজনামজার পর নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জয়ী হয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্ব পান । পরে তাকে ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেয়া হয় । গত ২০২০ইং সালের ২ জুন জ্বর, অ্যালার্জিসহ বার্ধক্যজনিত বিভিন্ন রোগে অসুস্থ অবস্থায় সাহারা খাতুনকে রাজধানীর ইউনাইটেড হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখানে তার অবস্থার অবনতি হলে ১৯ জুন সকালে তাকে আইসিইউতে নেয়া হয়। এরপর অবস্থার উন্নতি হলে তাকে গত ২২ জুন দুপুরে আইসিইউ থেকে এইচডিইউতে (হাইডিপেন্ডেন্সি ইউনিট) স্থানান্তর করা হয়। পরে ২৬ জুন সকালে শারীরিক অবস্থার অবনতি হলে আবারও তাকে আইসিইউতে নেওয়া হয় । পরে সেখান থেকে এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে করে তাকে থাইল্যান্ড নেওয়া হয়েছিল। ব্যাংকক স্থানীয় সময় রাত ১২টা ২৬ মিনিটে (বাংলাদেশ সময় বৃহস্পতিবার রাত ১১টা ২৫ মিনিট) থাইল্যান্ডের বামুনগ্রাদ হাসপাতালে নিভে গেল তার জীবনপ্রদীপ । থেমে গেল ৭৭ বছরের সংগ্রামী পথচলা । এখন যারা আওয়ামী লীগ করেন বা নেতা বলে পরিচয় দেন তাদের অনেকের নাম সাহেদ বা পাপিয়া । তাদের গায়ে মুজিব কোট থাকে । নারী হলে বুকে বঙ্গবন্ধু বা নৌকার ব্যাজ । আগের নেতাদের লেবাস লাগত না । তারা গায়ে যা চাপাক আর বুকে কিছু লাগাল আর না লাগাল মানুষ জানত তাদের নাম তাজউদ্দীন আহমেদ, সৈয়দ নজরুল কিংবা মনসুর আলী। সে যুগের শেষ প্রতিনিধিদের একজন চলে গেছেন । যার জীবনব্যাপী কোনো ঘুষ দুর্নীতি বা টাকা আত্মসাতের কোনো অভিযোগ নাই । দেশের প্রথম মহিলা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। কিন্তু নিজেই লাজুক হয়ে থাকতেন অন্যদের দাপটের কাছে। আকর্ষণ করার মতো বাহ্যিক তেমন কিছু ছিল না তার। যা ছিল তার নাম সরলতা আর দলের জন্য ভালোবাসা ও আনুগত্য । এরশাদবিরোধী আন্দোলন চলছে। মহাখালী, গুলশান এবং বনানী এলাকায় তেমন একটা বিক্ষোভ কখনোই হতো না। তবে নিয়মিত আওয়ামী লীগের একটি ছোট মিছিল আমতলী হয়ে মহাখালী রেলগেট পার হওয়ার চেষ্টা করত। সবসময় এর নেতৃত্ব দিতেন তামাটে বরন আর একহারা গড়নের এক নারী । সাদা শাড়ির ওপর কালো কোট বলে দিত সাহারা খাতুন একজন আইনজীবী। কিন্তু পুলিশের লাঠি ছিল ভ্রুক্ষেপহীন এবং সাহারা ছিলেন তার অবধারিত শিকার । জলখাবার রেস্টুরেন্টে চা খেতে খেতে রায়ট ডিভিশনের এক অফিসারকে একজন বলেছিল, ‘এ মহিলাকে এত পিটিয়ে আপনারা কী সুখ পান?’ তার জবাব ছিল, ‘মহিলাকে পেটাব কেন, ছেলেগুলোকে মারতে গেলেই উনি লাঠির সামনে এসে দাঁড়ান । আমরা যাই সব কন্ট্রোল করতে, ফুল তুলতে নয়। ব্যাস তার কপাল ফাটে, ঠোঁট কাটে, হাত ভাঙে।’ বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ তখন আজকের মতো ধনী ছিল না। কিন্তু দলে সাহারা খাতুনের মতো নেতারা ছিলেন। এখনকার আওয়ামী লীগ আর তখনের আওয়ামী লীগে আকাশ জমিন ফারাক। রাজপথের আওয়ামী লীগ মানুষের জনগণের দল। তখন এত মুজিব কোট ছিল না । এত লীগারও না। সে কঠিন সময়ে একজন সাধারণ আইনজীবী হিসেবে সাহারা খাতুনের কথা আপনারা ভুলতে পারেন কিন্তু সময় ভুলবে না । সাহারা খাতুন নির্বাচনে পরাজিত হয়েছিলেন । কিন্তু হার মানেননি। যার ফলে তিনবার জয় আর জয়ী হয়ে হয়েছিলেন বাংলাদেশের প্রথম নারী স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। সে পদ কখনও কারও জন্য সুখের কিছু হয় না। তার বেলায়ও হয়নি। তার সময়ে ঘটে গিয়েছিল দেশের ইতিহাসের এক ন্যাক্কারজনক হত্যাকা- । দেশ কাঁপানো মনভাঙা সেই হত্যাকা-ে উজাড় হয়ে গিয়েছিল আমাদের সাহসী বিডিআর বাহিনীর অফিসারের দল। সে দুর্ঘটনায় সাহারা খাতুনকে দেখেছিলাম মিডিয়ার সামনে অসংকোচ কিন্তু অসহায় । তার বিডিআর সদর দফতরে ছুটে যাওয়া প্রশংসিত হয়েছিল দেশ জুড়ে। এখনকার মৌসুমি নেতাদের দেখে তাকে বোঝা যাবে না। তিনি শেখ হাসিনার হয়ে যেমন আইনি লড়াই করেছেন তেমনি দলের বহু কর্মীর মামলাও করে দিয়েছেন বিনা পারিশ্রামিকে। তবে আমার মতে তার বড় অর্জন সরলতা আর সহজ জীবনের মধ্য দিয়ে লাইম লাইটে থাকা। তিনি এমন কোনো কথা বলতেন না যা চটকদার। চমকে দেওয়ার মতো কোনো ব্যক্তিত্বও ছিলেন না তিনি। কেবল নিষ্ঠা আর ত্যাগ দিয়ে দেশের সবচেয়ে বড় দলের শীর্ষপদে থাকা কঠিন কাজ। আজকের আওয়ামী লীগে ভোটে হারার জন্য দাঁড়ায় না কেউ। আর হার বলে কিছু নাইও। নাই কোনো প্রতিযোগিতা প্রতিদ্বন্দ্বিতা । তাদের সময় রাজনীতি ছিল। মানুষ ভোট দিতে যেত। তাই তিনি হারলেও সম্মান নিয়ে রাজনীতি করতেন আর জিতলে তা ছিল আর গৌরবের জয়। সাহারা খাতুনের মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে সে যুগের আরেকটি প্রদীপ নিভে গেল যে যুগ বাংলাদেশের রাজনীতিতে মানুষের রাজনীতি হিসেবে চিরকাল ভাস্বর থাকবে। সাহারা খাতুনের মৃত্যু আমাদের রাজনীতির জন্য যতটা ততটাই সাধারণ মানুষের গণতন্ত্রকে জানিয়ে দিলো, আমরা অভিভাবক শ্রেণির সাদামাটা মানুষদের আর কোনো দিন পাব না । পরপারে ভাল থাকবেন । এই কামনাই করি আপনার ৩য় মৃত্যুবার্ষিকীতে ।   

Jamie Belcher

info@jagobahe24.com

News portal manager

Follow Me:

Comments