সারাদেশ

ক্ষণজন্মা এক কীর্তিমান পুরুষ- বীর মুক্তিযোদ্ধা আলহাজ আব্দুল বারিক

মোল্লা তানিয়া ইসলাম তমাঃ বাংলাদেশের স্বাধীনতা এবং রাজধানীর তুরাগ থানা ও সাবেক হরিরামপুর ইউনিয়ন আওয়ামীলীগের রাজনীতির ইতিহাসে অবিস্মরণীয় এক নাম বীর- মুক্তিযোদ্ধা আলহাজ আব্দুল বারিক । ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের অকুতোভয় এক বীর সৈনিক তিনি । মুক্তিযুদ্ধকালীন বাংলাদেশ মুক্তিবাহিনীতে যোগ দিয়ে ৩নং সেক্টরের অধিনে অসামান্য দক্ষতার সঙ্গে যুদ্ধ করেছেন । অন্যান্য মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে নিয়ে পাক হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিরোধ গড়ে তুলেছেন একাধিকবার । স্বাধীন-সার্বভৌম লাল-সবুজের পতাকা খচিত বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায় এই মুক্তিযোদ্ধার অবদান অনস্বীকার্য । বাঙালি জাতীয়তাবাদ, বাংলাদেশ আওয়ামী রাজনীতি ও স্বাধিকার আন্দোলনের উজ্জ্বল নক্ষত্র বীর- মুক্তিযোদ্ধা আলহাজ আব্দুল বারিক । ১৯৫৫ইং সালের পহেলা জানুয়ারি রাজধানীর তুরাগের ধউর এলাকার এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন তিনি । তেজগাঁ পলিটেকনিকে অধ্যয়নকালীন সময়েই দেশে মহান মুক্তিযুদ্ধু শুরু হলে মুক্তিবাহিনীতে যোগ দিয়ে ৩নং সেক্টরের অধিনে মাত্র ১৬ বছর বয়েসে মুক্তিযুদ্ধে ঝাপিয়ে পড়েন বীর- মুক্তিযোদ্ধা আলহাজ আব্দুল বারিক । প্রতিবেদকের সাথে একান্ত আলাপ চারিতায় সাবলীল ভাষায় তিনি বলেন, শৃঙ্খলিত জীবন কারোরই কাম্য নয়। ব্যক্তি জীবনে যেমন স্বাধীনতা প্রয়োজন, তেমনি রাষ্ট্রের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব প্রয়োজন। সার্বভৌমত্বহীন রাষ্ট্র কোনো রাষ্ট্র নয়। স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রাষ্ট্রের নাগরিকদের নিজস্ব পরিচয় বহন করে। পিতৃপরিচয়হীন সন্তানকে যেমন সমাজ গ্রহণ করে না, তেমনি পরাধীন দেশের নাগরিকদের পৃথিবীতে কেউ মূল্যায়ন করে না। রাষ্ট্র ছাড়া নাগরিক পিতৃপরিচয়হীন সন্তানের মতো। একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র নাগরিকের জন্ম পরিচয় ও জাতীয় পরিচয় বহন করে। এই স্বাধীনতা সহজে আসেনি। এই স্বাধীনতা আন্দোলনের পটভূমি একদিনেও তৈরি হয়নি। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন থেকে ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন, ১৯৬২ সালের শিক্ষা সংকোচন নীতির বিরুদ্ধে আন্দোলন, ’৬৬-এর ছয় দফা আন্দোলন, ’৬৯-এর গণআন্দোলন, ’৭০-এর সাধারণ নির্বাচন ও ’৭১-এর অসহযোগ আন্দোলন ও পরিশেষে স্বাধীনতা যুদ্ধ। এই বিজয়ের পেছনে আছে ৩০ লাখ শহীদের আত্মত্যাগ ও তিন লাখ মা-বোনের সম্ভ্রম হারানোর বেদনা। এই বিজয়ের পেছনে বাঙালি জাতির সব শ্রেণির মানুষের অবদান অনস্বীকার্য । বীর- মুক্তিযোদ্ধা আলহাজ আব্দুল বারিক আরও বলেন, ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে ছাত্র-শিক্ষকসহ সমাজের শিক্ষিত শ্রেণি ছাড়াও কুলি, মুটে, মজুর, জেলে, কৃষকের স্বাধীনতা যুদ্ধে অবদান কোনোভাবেই ছোট করে দেখার অবকাশ নেই । বাংলাদেশ মূলত গ্রামপ্রধান দেশ। প্রায় ৬৮ হাজার ৩৯৪টি গ্রামের সমন্বয়ে গড়ে উঠেছে বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্র। এক একটি গ্রাম যেন একেকটি নকশি কাঁথা । একটা একটা করে সমস্ত নকশি কাঁথা একসঙ্গে জুড়ে এই ছবির মতো সুন্দর। এই আমাদের স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ। ‘সকল দেশের রানি সে যে, আমার জন্মভূমি’। পুরো দেশটা একটা বিরাট নকশি কাঁথা। এই সবুজ শ্যামল গ্রামগুলোই বাংলাদেশের আসল প্রাণশক্তি। মুক্তিযুদ্ধের বিরাট অংশজুড়ে রয়েছে গ্রামীণ জনপদের সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষের অবদান । দেশের কৃষক, শ্রমিক, মেহনতি মানুষ সমস্ত শক্তির অনুপ্রেরণা। এই কৃষক, শ্রমিক, মুটে, মজুর সহজ-সরল অক্ষর জ্ঞানহীন আত্মভোলা মানুষগুলো মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে হাতে সাহায্য-সহযোগিতা করেছিলেন। তারা সাধারণ পাড়া-গাঁয়ে বসবাস করলেও স্বাধীনতার মর্ম অন্তরে ধারণ করতে ও বুঝতে ভুল করেনি। পরাধীনতার শৃঙ্খলে বন্দি বিজাতীয় নরপশু হায়েনার হিংস্র থাবায় ক্ষতবিক্ষত বাঙালির জীবন বিষিয়ে উঠেছিল। দুঃশাসন ও শৃঙ্খল বন্দি জীবন থেকে মুক্তি পেতে মরিয়া হয়ে স্বাধীনতার জন্য আত্মত্যাগ করতে প্রস্তুত হয়ে ছিলেন। সাধারণ মানুষ বুঝে গিয়েছিলেন স্বাধীনতা ছাড়া এই মানুষরূপী হায়েনাদের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার কোনো রাস্তা খোলা নেই। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধে কৃষক, শ্রমিক, মেহনতি মানুষ যে বিরাট ভূমিকা রেখেছেন। তাদের আত্মত্যাগ দেশের স্বাধীনতাকে ত্বরান্বিত করেছিল। তারা অস্ত্র হাতে যুদ্ধের ময়দানে যেমন ছিলেন সম্মুখযুদ্ধে, তেমনিই ছিলেন অভ্যন্তরীণ প্রতিরোধ ও সশস্ত্র প্রতিরোধে শামিল । ’৭১-এ মুক্তিযুদ্ধে বেসামরিক সর্বস্তরের জনগণ নিয়ে গড়ে উঠেছিল মুক্তিবাহিনীর অনিয়মিত বাহিনী। এছাড়া দেশের অভ্যন্তরে আঞ্চলিক পর্যায়ে বেশকিছু ছোট ছোট বাহিনী গড়ে উঠেছিল সাধারণ জনগণকে নিয়ে। এসব বাহিনীর মধ্যে ‘কাদেরিয়া বাহিনী’, ‘মায়া বাহিনী’ ও ‘হেমায়েত বাহিনী’ উল্লেখযোগ্য। সব বিপদ তুচ্ছ করে বাংলার অগণিত জনতা শহরে, গ্রামে যে যেভাবে পেরেছিলেন রুখে দাঁড়িয়েছিলেন। কৃষক, শ্রমিক, সাধারণ মানুষ ব্যাপকভাবে মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন। অনেক বাঙালি সেনাবাহিনীর অফিসার বিদ্রোহ ঘোষণা করে, সেনানিবাস ছেড়ে সঙ্গী-সাথী নিয়ে স্বাধীনতা যুদ্ধে যোগ দান করতে রাস্তায় নেমে আসেন। গ্রামীণ জনপদের শত শত কৃষক পরিবারের নারী-পুরুষ রাস্তায় দাঁড়িয়ে তাদের অভ্যর্থনা জানায়। দেশের স্বাধীনতার জন্য যারা যুদ্ধ করতে বেরিয়েছেন তাদের আহারের জন্য নিজেদের কষ্টার্জিত অন্ন তাদের থালায় নির্দ্বিধায় ঢেলে দিয়ে ক্ষুধা নিবারণের ব্যবস্থা করেছেন এবং রাত্রিযাপনের জন্য হাসিমুখে নিজের বসতঘর ছেড়ে দিয়েছেন । মুক্তিযোদ্ধাদের একটু বিশ্রামের জন্য নিজেরা খোলা আকাশের নিচে রাত্রিযাপন করেছেন । ১৯৭১ সালে ৭ মার্চের ভাষণে বঙ্গবন্ধুর আহ্বান ছিল- ‘ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলো, যার যা কিছু আছে, তা নিয়ে শত্রুর মোকাবিলা করতে হবে।’ ওই আহ্বানে অধিকাংশ মানুষ যুদ্ধের জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুত হয়ে গিয়েছিলেন। বিভিন্ন স্থানে যুদ্ধের জন্য যে সব প্রশিক্ষণ কার্যক্রম শুরু হয়েছিল তাতে অনেক কৃষক, শ্রমিক, সাধারণ মানুষ অংশ গ্রহণ করতে শুরু করেছিলেন । ২৫ মার্চ কালো রাতের গণহত্যার আগেও এদেশের কৃষক, শ্রমিক, মেহনতি সাধারণ মানুষই পাকিস্তানি সৈন্যদের প্রতিরোধ করতে এগিয়ে এসেছিলেন। ২৫ মার্চ কালো রাতে গণহত্যা সংঘটিত হওয়ার পরেও দেশের সর্বত্র কৃষক, শ্রমিক, সাধারণ জনগণ স্বতঃস্ফূর্তভাবে প্রাথমিক প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিলেন। এভাবে বাংলার কৃষক লাঙল ফেলে মুক্তিযুদ্ধে গেছেন, শ্রমিক কারখানার কাজ ফেলে মুক্তিযুদ্ধে অংশ গ্রহণ করেছেন। মাঝি নৌকার হাল কাঁধে নিয়ে যুদ্ধের ময়দানে বীরদর্পে শত্রুর মোকাবিলা করেছেন । দেশাত্মবোধে উদ্বুদ্ধ হয়ে কৃষক, শ্রমিক, মেহনতি মানুষ সরাসরি ও পরোক্ষ যুদ্ধে নিজেদের সম্পৃক্ত করে স্বাধীনতা যুদ্ধের বড় হিস্যা হয়ে রয়েছেন। এটাই তাদের মহত্ত্ব ও বীরত্ব । ৭ মার্চ ’৭১ সালে বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণ শুনে উদ্বুদ্ধ হয়ে আমরা অস্ত্র হাতে তুলে নিয়েছিলাম । তখন আমাদের মানে স্বাধীনতায় বিশ্বাসীদের একটাই স্বপ্ন ছিল বুকে- মাতৃভূমিকে শত্রু মুক্ত করতে হবে। তাই যুদ্ধের শুরুতে পাকহানাদার বাহিনীর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছিলাম । বীর- মুক্তিযোদ্ধা আলহাজ আব্দুল বারিকের কোনো চাওয়া-পাওয়া নেই । শুধু একটাই অন্তরে সাধ- স্বাধীন দেশের নাগরিক হিসেবে মরতে পারবেন এতেই তিনি গর্বিত।

Jamie Belcher

info@jagobahe24.com

News portal manager

Follow Me:

Comments