September 20, 2024
মুক্তমত

শঙ্কা নয়, সতর্কতায় হোক শারদীয় দুর্গাপূজা: তপন কুমার রায়

দুয়ারে কড়া নাড়ছে সনাতন তথা হিন্দু ধর্মালম্বীদের শারদীয় দুর্গাপূজা। হিন্দু ধর্মালম্বীদের অন্যতম প্রধান এই পূজা দুর্গোৎসব হিসেবে পরিগণিত হয়। উৎসব মানেই আনন্দ। ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠানের পালনের সাথে দুর্গাপূজার মন্ডপগুলো আনন্দপূর্ণ বা জাঁকজমকপূর্ণ নানা রকম অনুষ্ঠানে মুখরিত হয়ে উঠে। এবারও পূজায় এর ব্যতিক্রম হবে না বৈকি? তবে গেল বছর পূজার শুরু, পুজার সময় এবং শেষটা হয়েছিল দুঃসংবাদ দিয়ে। পূজার শুরুতেই সর্ব উত্তরের পঞ্চগড় জেলার বোদা উপজেলার বদেশ^রী মন্দিরে মহালয়া উপলক্ষে ধর্মসভার অনুষ্ঠানকে কেন্দ্র করে নৌকা ডুবিতে মোট ৭২ জনের মৃত্যু শোকে মহালয়ায় যেন বিসর্জনের ধ্বনি বেঁজে উঠেছিল। স্মরণকালে ভয়াবহ আউলিয়া ঘাটের নৌকাডুবির ঘটনা সারাদেশের মানুষের মনে তাৎক্ষণিক ভাবে যে ক্ষত সৃষ্টি করেছে তা সময়ের পরিক্রমায় দেশের মানুষ ভুলে গেলেও ভুক্তভোগী পরিবারগুলো কি ভুলে যেতে পেরেছে? গেল বছর দুর্গাপুজা চলাকালীন কুমিল্লা শহরের নানুয়াদীঘির পাড়ের পূজা মন্ডপের ঘটনার জের ছড়িয়ে পড়েছিল দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে। আর পূজার শেষটা হয়েছিল প্রতিবেশী দেশ ভারতের পশ্চিমবঙ্গের জলপাইগুড়ি জেলার মালবাজারের মাল নদীতে প্রতিমা বিসর্জনে আকস্মিক হড়পা বানে ০৮ জন মৃত্যুর খবরে। এছাড়া দুর্গাপূজা আসলেই কতিপয় মানবসৃষ্ট কর্মকান্ডে হিন্দুধর্মালম্বীদের মনে নানান শঙ্কা দেখা দেয়। যদিও এসব কর্মকান্ড বিচ্ছিন্ন ঘটনা মাত্র। তথাপি এ বছর দুর্গাপূজার পাশাপাশি দুয়ারে কড়া নাড়ছে জাতীয় সংসদ নির্বাচন। নির্বাচনে অংশগ্রহণ করা না করাকে কেন্দ্র করে গণমাধ্যমের খবর অক্টোবর মাস দেশের অন্যতম রাজনৈতিক দল বিএনপির আন্দোলনের মাস। যদিও গণমাধ্যমেরই খবর, দুর্গাপূজার সময়টাতে রাজনৈতিক দল বিএনপির কোন কঠোর আন্দোলন থাকছে না। সব মিলিয়ে কেমন হতে চলছে এবারের দুর্গাপূজা? প্রাকৃতিক কিংবা মানবসৃষ্ট ঘাত প্রতিঘাতের নানা রকমের শঙ্কা থাক আর না থাক এবারের পূজা হোক সর্বোচ্চ সতর্কতায়। অবশ্য পূজা সুষ্ঠু ও স্বাভাবিক ভাবে অনুষ্ঠানের লক্ষ্যে বাংলাদেশ পূজা উদযাপন পরিষদ-কেন্দ্রীয় কমিটি ইতিমধ্যে দেশের সকল পূজা মন্ডপ কমিটির উদ্দেশ্যে ২৫ দফা গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশনা প্রদান করেছেন। পূজা মন্ডপগুলো বাংলাদেশ পুজা উদযাপন পরিষদ-কেন্দ্রীয় কমিটির প্রদত্ত ২৫ দফা নির্দেশনা পুঙ্খানুপুঙ্খরূপ ভাবে মেনে চললে মন্ডপে অনাকাঙ্খিত ঘটনা এড়ানো সম্ভব হবে। এছাড়াও আসন্ন দুর্গাপূজা ও জাতীয় নির্বাচন উপলক্ষে দেশের সার্বিক আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় মাঠ পর্যায়ে স্থানীয় প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় নিয়োজিত বিভিন্ন দপ্তর সমূহ জোরালো ভূমিকা পালন করছে। দেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় পুলিশের মাঠকর্মী হিসেবে উপলব্ধি পূর্বক বলা বাহুল্য যে, আসন্ন দুর্গাপূজায় অনাকাঙ্খিত ঘটনা এড়াতে পুলিশের মাঠ পর্যায়ের সদস্যদের কার্যক্রম প্রত্যক্ষভাবে পুলিশের উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ সার্বক্ষণিক তদারকি করছেন। পুলিশ সদস্য ও উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ প্রতিটি পূজামন্ডপ নিয়মিত ভাবে পরিদর্শন করছেন। গোয়েন্দা তৎপরতা বৃদ্ধি করা ছাড়াও সারাদেশে সংশ্লিষ্ট জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপার, উপজেলা নির্বাহী অফিসার ও অফিসার ইনচার্জ মহোদয় গণ বাংলাদেশ পূজা উদযাপন পরিষদের জেলা-উপজেলার কমিটি ও পূজা কমিটির দায়িত্বরত ব্যক্তিদের সাথে এক বা একাধিক আইনশৃঙ্খলা সভা সম্পন্ন করেছেন এবং অব্যাহত রেখেছেন। সর্বোপরি আসন্ন দুর্গাপূজায় কোনো অনাকাঙ্খিত ঘটনার দায়ভার এড়ানোর সুযোগ যেমন রাষ্ট্রের নেই, তেমনি সংশ্লিষ্ট পূজা কমিটিও এর দায়ভার এড়াতে পারেনা। সামনে যেহেতু জাতীয় নির্বাচনের ঢামাঢোল বাঁজছে তাই নির্বাচন কেন্দ্রিক সাম্প্রদায়িক সহিংসতা এড়ানোর বিষয়ে রাষ্ট্রের সাথে কাঁধে কাধঁ মিলিয়ে আমাদেরকেই সর্তকতার সঙ্গে পূজার কার্যক্রম পরিচালনা করতে হবে। এই চ্যালেঞ্জ যেমন রাষ্ট্রের, তথাপি রাষ্ট্রের সুবিধাভোগী হিসেবে এই চ্যালেঞ্জ আমাদের সকলের। তাই দুর্গাপূজায় অনাকাঙ্খিত ঘটনাসহ নির্বাচন কেন্দ্রিক সাম্প্রদায়িক সহিংসতার বিষয়টি মাথায় রেখে পূজা উদযাপন পরিষদ জেলা ও উপজেলা কমিটি এবং সংশ্লিষ্ট পূজা মন্ডপ গুলো বাংলাদেশ পূজা উদযাপন পরিষদের প্রদত্ত নির্দেশনা ছাড়াও নিম্মোক্ত পয়েন্টগুলো মেনে চলতে পারেন-
১। দুর্গাপূজার অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণের ক্ষেত্রে আসন্ন জাতীয় নির্বাচনে যে কোনো রাজনৈতিক দলের কিংবা স্বতন্ত্র সম্ভাব্য কোন একক প্রার্থীকে প্রাধান্য দেওয়া থেকে বিরত থাকার চেষ্টা করতে হবে। যেহেতু নির্বাচন সন্নিকটে প্রার্থীরা পূজা মন্ডপের অনুষ্ঠানে বক্তব্যের মাধ্যমে নিজেদের যোগ্যতা প্রমাণ করার চেষ্টা করবে এটাই স্বাভাবিক। সু-সম্পর্ক বলেন আর প্রতিশ্রুতি বলেন কোনো একক প্রার্থীকে মন্ডপে প্রাধান্য দিলে অন্যান্য প্রার্থীগণের সংশ্লিষ্ট পূজা মন্ডপের প্রতি খারাপ মনোভাব কিংবা মনোবাসনা তৈরি হতে পারে।
২। পূজা মন্ডপের ভিতরে ও বাহিরে অথ্যাৎ মন্ডপের অবকাঠামোর মধ্যে আসন্ন জাতীয় নির্বাচনের সম্ভাব্য প্রার্থীদের প্রচারণায় ব্যবহৃত দৃশ্যমান কোন সাইনবোর্ড, ব্যানার, ফেস্টুন, বিলবোর্ড সহ অন্যান্য বস্তু টাঙ্গানো বা প্রদর্শন থেকে বিরত থাকতে হবে।
৩। পূজার অনুষ্ঠানে মন্ডপের কমিটির কোন সদস্য আসন্ন জাতীয় নির্বাচনে কোনো সম্ভাব্য প্রার্থীর পক্ষে বক্তব্য প্রদান, শুভেচ্ছা জ্ঞাপন, আশীর্বাদ কিংবা দোয়া প্রার্থনা করা থেকে বিরত থাকতে হবে।
৪। কথা অপ্রিয় হলেও সত্য যে, সবক্ষেত্রে না হলেও অনেক পূজা মন্ডপের কমিটির কর্তৃত্বের পদ-পদবীসহ মন্ডপের জমি সংক্রান্ত বিষয়ে অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব থাকতে পারে। উক্ত বিষয়ে পূজা উদযাপন পরিষদের কেন্দ্রীয়, জেলা কিংবা উপজেলা কমিটিকে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে বৃহৎ স্বার্থে দ্বন্দ্ব নিরসনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে।
৫। একই পাড়া বা মহল্লায় অবস্থিত নিকটবর্তী মন্ডপগুলো শ্রেষ্ঠত্বের দাবিদার হিসেবে স্বীকৃতি লাভের আশায় প্রতিযোগিতার মনোভাব পরিহার করতে হবে।
সবশেষে পূজার আনন্দ ছড়িয়ে পড়–ক সবার মাঝে। দুর্গতিনাশিনী মায়ের প্রাথনায় মুখরিত হোক পূজা মন্ডপগুলো। আকাশে-বাতাসে ধ্বনিত হোক ঢাকের সুর, শঙ্খ আর উলুধ্বনি। প্রকৃতিতে দোল খাওয়া শুভ্র কাঁশফুলের ন্যায় মন্ডপগুলোতে ঢাকের তালে নেচে উঠুক প্রতিটি নিষ্পাপ মানবের মন। পূজার আগমনী ধ্বনিত হোক কবির কবিতায়-
“আজি এ শারদ সাঁঝে-
ঐ শোনো দুরে পল্লী-মুখর কাঁসর, ঘন্টা বাজে।
দিনমণি যায়-‘বিদায় বিদায়’
বিহগ-কন্ঠে দিশি দিশি ধায়
উদ্দাম বেগে, মরম আবেগে, মত্ত তটিনী চলিছে;
ধীরে ধীরে তীরে তীরে, শ্লথ মন্থর বীচিমালা ফিরে
গাহিয়া সবারি কাছে।
পবনে গগণে জনে জনে বনে ঐ, কল্লোলময়ী গীতি-
নিখিল বিশ্বে একই রাগিনী ধ্বনিতেছে নিতি নিতি ;
একই মন্ত্রে একই সাধনা একই আরতি বাজে
মনোমন্দির মাঝে।”

লেখক:
পুুলিশ উপ-পরিদর্শক
ই-মেইল: ঃ tapanbp20@gmail.com

Jamie Belcher

info@jagobahe24.com

News portal manager

Follow Me:

Comments