শিক্ষা একটি পণ্য, কে বানাচ্ছে? দরকার এই সমাজব্যবস্থার রূপান্তর।
ভাষা: আমরা মাতৃভাষার অভিমানে ভুগি। এর কারণ আছে। কিন্তু বস্তুসত্যের কোনো ভাষা নাই। ভাষা একটা চিহ্ন যা দিয়ে আমরা বস্তু চিনি। আর শিখি কিন্তু বস্তুর সত্যটা। সেটা তার বৈশিষ্ট্য। এটা শিখতে গিয়ে যে ভাষা উপযোগী, আমি তাই শিখবো। শেখা কিন্তু কোনো স্বয়ম্ভূ কিছু নয়, এটা করতে গেলে নির্দিষ্ট প্রক্রিয়ার মধ্যে যেতে হবে। মাতৃভাষা আমরা আপনাআপনি পেয়ে যাই বলে সেটাই উপযুক্ত, এমন কোনো কথা নয়। কারণ জ্ঞান পৃথিবীর যেকোনো ভাষায় উৎপাদিত হতে পারে, আমরা তা শেখার জন্য সবচাইতে উপযুক্তটি বেছে নেবো। মাতৃভাষায় সেটা হতেই হবেÑ এমন কোনো কথা থাকতে পারে না।
তার মানে এই নয়, মাতৃভাষাকে অবহেলা করবো। মাতৃভাষাকে আমরা উন্নত করবো অন্যের উন্নত ভাষাকে রপ্ত করে। কারণ তারা আমাদের চেয়ে জ্ঞান উৎপাদনে এগিয়ে। তাহলে আমরা মাতৃভাষার পাশাপাশি এমন ভাষা শিখবো, যা আমাদের জ্ঞানকে সমৃদ্ধ করবে পাশাপাশি মাতৃভাষাও তাকে আত্মীকৃত করতে এগিয়ে আসবে। মনে রাখা দরকার ভাষা কোন স্থির বিষয় নয়, এটা অর্থনৈতিক উন্নয়নের সঙ্গে জড়িত। যে জাতি যতো উন্নত, তার ভাষা ততো উন্নত। আমরা মাতৃভাষার পারদর্শীতা বলতে শুধু ভালো লেখা বা পড়া বুঝি, আসলে তা হবে কতোটা জ্ঞানের বিষয়কে ভাষায় প্রকাশের যোগ্য করে তুলতে পেরেছি, তা বোঝায়।
একটা শিশু বড় হয়ে কী হবে, তা সেই শিশু কী করবে বুঝবে? এই বোঝাটা সামাজিক। পরিবার এবং সমাজ তাকে এই ধারণা দেবে ক্রমশ। ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার আর্কিটেক্ট বা গায়ক কোনো জেনেটিক বিষয় নয়, এটা সাংস্কৃতিক। সংস্কৃতি মানে হচ্ছে আমি অর্থনৈতিকভাবে যা ধারণ করছি তার চিন্তার ফলিত রূপ। যেমন আমি জানতাম না আর্কিটেকচার কী, জানতাম ডাক্তার কী, তাই আমি ডাক্তার হতে চেয়েছি। কিন্তু আমি তো আসলে ডাক্তার হতে চাইনি, আমি চেয়েছি সংগীতশিল্পী হতে। এটা হতে পারিনি। কারণ সংগীত আমার সংস্কৃতির অংশ ছিল না। এখন আমি যখন স্কুলে যাবো, তখন আমি ডাক্তার হবোÑ এই আশায় যাবো না, আমি যাবো একটা কমন শিক্ষা অর্জনের জন্য। ক খ কী করে লিখতে হয়, তা জানতে। ক্রমশ একটা আয়তাকার বস্তুর ঘনফল কী করে নির্ণয় করতে হয় তা জানতে।
এসব কমন বিষয় সবাইকে জানতে হবে। এটাই সমাজস্থিত মানুষের সহাবস্থান এবং শিক্ষার নীতি। মনে করুন, একটা কৃষিজমি। কী ফলাবেন, তা পরে, আগে তাকে উপযুক্ত করতে লাগবে মাটিকে উৎপাদন উপযোগী করা। একজন কৃষক ফসল বুনবার আগে তাই করে, বহিবার মাটিকে সমান করে লাঙল দিয়ে, ট্রাক্টর দিয়ে। আমার যখন ভিত্তি রচনার কাজ শেষ হবে, তখনই কেবল আসবে কে কোন বিষয় নির্বাচন করবে তা বেছে নেওয়ার। এই বেছে নেওয়াও কি সবসময় নিজের ইচ্ছা দ্বারা তৈরি হয়? হয় না। আমরা একটা ব্যবস্থার অধীন থাকি, সেই আমাদের নিয়ন্ত্রণ করে। যেমন এখন নিয়ন্ত্রণ করছে পুঁজি। পুঁজির বাইরে এক পাও ফেলার জো নেই। সেই আপনাকে কানে কানে বলছে, ‘তুই এটা হ, তুই ওটা হ’। এই হ’ কিন্তু এমনি এমনি কেউ বলছে না, বলছে তার স্বার্থকে চরিতার্থ করার জন্য। পুঁজির স্বার্থ কী? তার অনুগত হওয়া। সে এমন মানুষ তৈরি করবে যে তাকে শ্রমশক্তি যোগান দেবে, তার শণৈ শণৈ মুনাফা অর্জিত হবে। মানবসম্পদ আর কিছুই নয়, শ্রমশক্তির ঘনীভবন। যে যতো এই শ্রমশক্তির উৎপাদন করতে পারবে, সে ততো মুনাফা লুটবে।
শিক্ষা একটি পণ্য। কে বানাচ্ছে? পুঁজি। কিন্তু মনে রাখতে এই পুঁজি দেখছে তার স্বার্থ, অর্থাৎ পুঁজিপতি এর মাধ্যমে মুনাফা তৈরির পণ্য বানাচ্ছে। সে জানে কোন শিক্ষা তাকে এই লাভ দেবে। সে দেখছে ব্যক্তির দক্ষতা যা দিয়ে সে মুনাফা করবে। এই মুনাফা সে নিজে আত্মসাৎ করবে এবং ভোগ করবে। আপনি যদি এটা না চান, তাহলে পুঁজির বিরুদ্ধে লড়তে হবে। আছে কি আপনার সেই হিম্মত? যদি না থাকে, তাহলে আপনি পুঁজির দাস হয়ে থাকুন, ঘেউ ঘেউ করবেন না। এখন যারা এনিয়ে ঘেউঘেউ করে, তারা আসলে পুঁজিবাদেরই একটু উন্নত দাস হতে চায়। দরকার এই সমাজব্যবস্থার রূপান্তর।
Comments