মুক্তমত
শান্তি ও গণতন্ত্রের জন্য অশনিসংকেত
।। মোল্লা তানিয়া ইসলাম তমা ।।
লেখালেখি এখন অনেকটাই নেশার মত হয়ে গিয়েছে । তাই একটু সময় পেলেই কোন এক বিষয় নিয়ে একটু আধটু লেখার চেষ্টা করি । কয়েক দিন ধরেই বিভিন্ন খবরের কাগজে দেখছি ছাত্র সংগঠনের সহিংস/সশস্র মহড়ার ছবি আর খবর পড়ে ছাত্র রাজনীতি নিয়ে সামান্য কিছু লেখার আগ্রহ জাগলো । যদিও এইসব বিষয় নিয়ে লিখতে মোটেও আমি প্রস্তুত নই । তাছাড়া রাজনীতি নিয়ে আমার সংশ্লিষ্ঠতা আর আগ্রহ না থাকায় হয়ত সমাস্যার গভীরে যাওয়া সম্ভব হবেনা । তারপরেও নিজের মনোভাব পাঠকদের সাথে একটু শেয়ার করা! তাই আমার লেখায় কোন ভুলত্রুটি হলে সকলেই ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন । পূর্বে থেকেই দেখছি রাজনৈতিক ক্ষমতার পালাবদলের শুরু থেকেই দেশের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে আধিপত্য বিস্তার, তুচ্ছ ঘটনা নিয়ে সহিংসতা, ভাঙচুর ও সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে, ঘটছে, হয়তো আগামীতেও ঘটবে । বিভিন্ন ক্যাম্পাস উত্তপ্ত হয়েছে, হচ্ছে, হয়তো আগামীতেও হবে । যে দু-একটা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পূর্বে বা এখনও শান্ত আছে সেখানেও চলছে ষড়যন্ত্র, চলছে ক্ষমতা আর অস্রের মহড়া । এ পরিস্থিতি মোকাবিলায় কর্তৃপক্ষ কার্যকরী পদক্ষেপ না নেয়ায় শিক্ষার পরিবেশ বিনষ্ট হয়েছে, ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে দেশ ও জাতির । বর্তমান সরকার দিন বদলের অঙ্গীকার নিয়ে ক্ষমতায় এসেছে । কিন্তু একটি কুচক্রী মহল এই দিনবদলের শ্লোগানকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করতে উঠেপড়ে লেগেছে । আর এই কুচক্রী মহলটির কু চক্রের বলি হচ্ছে অসংখ্য শিক্ষার্থী । স্বাধীনতার পরর্বর্তী সময় বিশেষ করে ষাট ও সত্তরের দশক থেকে ছাত্র আন্দোলন ও ছাত্র রাজনীতি শব্দ দুটোর ব্যাপক প্রচলন হয়েছে আমাদের দেশে । যেখানে জ্ঞানার্জনই হবে ছাত্রদের একমাত্র তপস্যা । আজ সে ধ্যান-ধারণার আমূল কিছুটা পরিবর্তন হয়েছে বলা যায় । এক শ্রেনীর ছাত্র নামধারী সন্ত্রাসী, ছাত্র নামধারী ক্যাডারদের জন্য ছাত্রদের জ্ঞানার্জন গোল্লায় যেতে বসেছে । লেজুড়বৃত্তি সর্বস্ব ছাত্র রাজনীতির কর্মীদের কাছে “অধ্যয়ন” নামক শব্দটির অবস্থা আজ ত্রাহি মধুসূদন। পবিত্রতার সঙ্গে অতুলনীয় এবং মানব সম্পদ সৃষ্টির উতপত্তিস্থল হিসেবে পরিগণিত অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান আজ দূরাচার এবং অপরিপক্ক রাজনীতির আখড়ায় পরিণত হয়েছে-বিষয়টি সচেতন মহলের কাছে যথেষ্ট পীড়াদায়ক। ক্ষমতালোভী ও কালিমালিপ্ত রাজনীতির ব্যবসায়ীরা নিজেদের আখের গোছাতে দুর্বার প্রাণশক্তির অধিকারী ছাত্রদের কুতসিত ভাবে ব্যবহার করছেন । রাজনীতি ও ছাত্র আন্দোলনের নামে কোন কোন ক্ষেত্রে দেশের ভবিষ্যত ছাত্রসমাজকে বেপথে ঠেলে দেয়া হচ্ছে । ক্যাম্পাস ও ততসংলগ্ন এলাকায় তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে ধাওয়া, পাল্টা-ধাওয়া, ভাঙচুর, মারামারি এবং খুনোখুনির ঘটনা অহরহ ঘটছে । এমনটি দেশের ছাত্রসমাজের কাছ থেকে সাধারণ জনগণ মোটেই আশা করেন না । ছাত্র আন্দোলন ও ছাত্র রাজনীতি সমার্থক নয় । রাজনীতিবিদদের স্বৈরাচার, ভ্রষ্টাচার অথবা সমাজে দেখা দেওয়া বিশৃঙ্খলা, কুসংস্কার প্রভৃতি দূর করে রাষ্ট্র ও সমাজের পুননির্মাণের ক্ষেত্রে ছাত্ররা ঐক্যবদ্ধভাবে ভূমিকা পালনের ক্ষমতা রাখে । এভাবে যে অফুরন্ত প্রাণশক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে সফলতা অর্জন করে, সে প্রক্রিয়াকেই বলা যায় ছাত্র আন্দোলন । সমস্ত বাধা-বিপত্তি ও প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে ছাত্র কল্যাণ তথা রাষ্ট্রকল্যাণের যে ক্ষমতা ছাত্ররা রাখে, সেটার প্রকৃত মূল্যায়নই হচ্ছে ছাত্র আন্দোলন কথাটার প্রকৃত অর্থ । অথচ এ প্রকৃত অর্থটাকে আজ বিভিন্নভাবে বিকৃত করে তোলা হচ্ছে । দেশপ্রেম, রাষ্ট্রীয় ঐক্য, শিক্ষা প্রভৃতি উপাদান ছাত্র রাজনীতিতে প্রতিফলিত হচ্ছে না । ছাত্র-ছাত্রীদের দাবি নিয়ে সুসংহতভাবে ছাত্র আন্দোলনকে পরিচালিত করার বদলে এটা শুধুমাত্র মতলববাজ রাজনীতির হাতের পুতুলে পরিণত হয়েছে । ফলে এখনকার ছাত্র রাজনীতি ও আন্দোলন ব্যর্থ ও দিক ভ্রান্ত হচ্ছে । পরাধীন দেশে স্বাধীনতা সংগ্রামে ছাত্ররা ছাত্র আন্দোলন যেমন ভূমিকা রেখেছিলেন তেমনি তারা মুক্তি সংগ্রামে ব্যাপকভাবে অংশগ্রহণ করে একটি নতুন মাত্রা সংযোজন করতে পেরেছিলেন নিঃসন্দেহে । শুধু তাই নয়, সে সময়ের নব্য শির্ক্ষার্থীরাই সমাজে প্রচলিত কুসংস্কার, অন্ধবিশ্বাস ও ধর্মান্ধতা দূর করে শিক্ষার ও পরিবেশ সৃষ্টিতে যথেষ্ট সচেষ্ট হয়েছিল । তাই আজকের আধুনিক দেশ গঠনে তাদের অবদান অনস্বীকার্য । সব থেকে বড় কথা, এ সব গঠনমূলক কাজ বা সদর্থক ছাত্র আন্দোলনে মনোনিবেশ করার পূর্বে ছাত্রদের চরিত্র গঠনের যেসব গুণাবলী অর্জন করতে হয় বা সুনাগরিক হওয়ার পাঠ গ্রহণ করতে হয় সে মানসিকতা তখনকার ছাত্রদের মধ্যে থাকলেও আজকের ছাত্রদের মধ্যে তার সিকি ভাগও পরিলক্ষিত হচ্ছে না এর কারন কি? । সুনাগরিক নির্মাণের কেন্দ্র হচ্ছে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান । তাই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো রাজনৈতিক দল, ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর চাপ ও সংস্কার মুক্ত হওয়া বাঞ্ছনীয় । কিন্তু বর্তমানে প্রায় সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রধানগণ সরাসরি কোন না কোন রাজনৈতিক দলের হয়ে কাজ করেন । শিক্ষা কেন্দ্রগুলোতে চরম বিশৃঙ্খলা, নৈরাজ্য ও রাজনৈতিক দ্বন্দ্বের ব্যাপক অনুপ্রবেশ ঘটেছে ছাত্র আন্দোলন এবং ছাত্র রাজনীতির চোরাপথ দিয়ে । উল্লেখ, ষাটের দশকে সারা বিশ্বে ছাত্র আন্দোলন বিশেষভাবে সমাদৃত হয় । বিশেষ করে দক্ষিণ ভিয়েতনাম, বলিভিয়া, সুদান, পোল্যান্ড, হাঙ্গেরী, চীন প্রভৃতি রাষ্ট্রে ছাত্র আন্দোলনের ঢেউ দেশের শাসন কর্তাদের দুরভিসন্ধিকে সংযত রাখতে সক্ষম হয় । এতে শুধু জনপ্রিয়তা নয়, ছাত্র শক্তির প্রকৃত মূল্যায়নের দিকটিও উন্মোচন ঘটে । ১৯৫২ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা ভাষাকে কেন্দ্র করে যে আন্দোলনের সূচনা করেছিল, পরবর্তীকালে ১৯৭১ এ তা মুক্তিযুদ্ধের রূপ নিয়ে একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্ম দেয় । বাংলাদেশের স্বাধীনতা লাভে ছাত্র সমাজের ত্যাগী ভুমিকা স্বাধীনতার ইতিহাসে উজ্জ্বল হয়ে থাকবে । ছাত্ররা রাজনীতিতে অপাঙক্তেয় নয় । তারা যে কোনও গঠনমূলক কাজের জন্য সংঘবদ্ধ হোক, আন্দোলনের মাধ্যমে নিজেদের সক্ষমতার প্রমাণ রাখুক তা সকলেই কামনা করেন । কিন্তু জাতীয় রাজনৈতিক দলের ঘোষিত-অঘোষিত এজেন্ডা বাস্তবায়নে যন্ত্রের মত আজ্ঞাবাহী হয়ে কাজ করে গেলে জনমানসে তাদের আর বিশ্বাসযোগ্যতা থাকে না । পরিতাপের বিষয় আমরা দেখতে পাচ্ছি কোন কোন ছাত্র সংগঠনের বার্ষিক অধিবেশনে জটিল রাজনৈতিক ইস্যু নিয়ে ঢাকঢোল পেটানো হচ্ছে । ঘোষিত হচ্ছে প্রতি পক্ষ রাজনৈতিক দলকে "উচিত শিক্ষা দেয়া"র / "দাঁত ভাংগা জবাব" কিম্বা "দীগম্বর করার" আন্দোলনের কর্মসূচী । বর্তমানে তেমন ভাবে কোনও ছাত্র সংগঠনই ছাত্রকল্যাণ কিংবা শিক্ষামূলক কর্মসূচী নিয়ে এগিয়ে আসছেনা । দু একটি ছাত্র সংগঠন ভিন্ন আর কোনো ছাত্র সংগঠন তাদের কর্মসূচীতে থাকেনা-শিক্ষা ও শিক্ষা ব্যবস্থার মান উন্নয়নের কর্মসূচী । থাকেনা কিভাবে লাইব্রেরিতে বইয়ের সংখ্যা বাড়ানো যাবে, কিভাবে বিজ্ঞানাগারে মান উন্নত করা যাবে । কিভাবে ছাত্র সমাজের মূল্যবোধের অবক্ষয়ের প্রতিরোধ করা যায়, কিভাবে শিক্ষাঙ্গনে সুন্দর ও সুস্থ পরিবেশ বজায় রাখা যায়, শিক্ষকদের অভাব কিভাবে পূরণ করা যায়, এসব নিয়ে ছাত্র সংগঠনগুলির কোন দিক-নির্দেশনাই থাকে না । এ ব্যাপারে সচেতন ও সাধারণ ছাত্র-ছাত্রীদের কোনো ততপরতাও নেই । একমাত্র ভালো ছাত্রদের, অবিভাবকদের সচেতনতা এবং সরকারের সদ্বিচ্ছাতেই যুগের দায়িত্ববান নাগরিক হিসেবে বর্তমান রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিস্থিতির পুষ্টিবিধানে ছাত্ররা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে । কিন্তু লেজুড়বৃত্তি নির্ভর হয়ে ছাত্র আন্দোলন ও ছাত্র রাজনীতি সফল হতে পারে না। আবার শিক্ষাকে বাদ রেখে ছাত্র আন্দোলন একটি হাস্যকর ব্যাপার মাত্র । কাজেই ছাত্র-ছাত্রীদের দাবি-দাওয়া, ক্যাম্পাস পরিস্থিতি ও সময়ান্তরে জনগণের প্রকৃত সমস্যা ও প্রয়োজনকে সামনে রেখে অগ্রসর হতে হবে । তবেই ছাত্র আন্দোলন যথার্থভাবেই আন্দোলনের মর্যাদা লাভ করবে । একটি সুশিক্ষিত প্রজন্ম গড়ে উঠলে তারাই এরকম একটি বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখাবে । তার আগে দরকার সুশিক্ষার পরিবেশ । ছাত্র রাজনীতিতে দুর্বৃত্তায়ন এই প্রক্রিয়াটিকে অনেক দূরে ঠেলে দিচ্ছে । সুতরাং ছাত্র রাজনীতিকে একটি পরিচ্ছন্ন পরিবেশ দেওয়া সময়ের দাবি । এই পরিবেশ ততক্ষণ তৈরি হবে না, যতক্ষণ পর্যন্ত রাজনৈতিক অভিভাবকবিহীন ছাত্র সংগঠন গড়ে না উঠবে । একটি রাজনৈতিক দলের ছাত্র সংগঠন পরিপূর্ণভাবে কখনো অসংগতির বিরুদ্ধে কথা বলতে পারবে না । তারা ছাত্রদের জন্য উন্নয়নমূলক কিছু করার মঞ্চটিও পাবে না—অতীতের ইতিহাস তাই বলে । সুতরাং ছাত্র রাজনীতিকে হতে হবে স্বয়ংসম্পূর্ণ । এ ছাড়া সুস্হ রাজনীতির বিকাশের জন্য আদর্শভিত্তিক দলগুলোকে প্রতিযোগিতা মূলক ভাবে কাজ করতে হবে এবং লেজুড়বৃত্তিক তোষণের সংস্কৃতি ছাড়তে হবে । মুক্তবুদ্ধির চর্চা বাড়ানোর জন্য কার্যকরীপদক্ষেপ হাতে নিতে হবে । এ পদক্ষেপগুলো গ্রহণ করতে পারলেই ছাত্ররা ছাত্র রাজনীতির সুফল লাভ করতে শুরু করবে এবং তারাও ভয়ভীতি কাটিয়ে ছাত্র রাজনীতিতে আসা শুরু করবে । ছাত্ররাজনীতি গতানুগতিক পড়াশোনার বাইরের একটি প্রতিষ্ঠান যেটা শেখায়, অভিজ্ঞতা বাড়ায় তথা সমাজ সংস্কার, অর্থনীতি, স্বরাষ্ট্রনীতি, পররাষ্ট্রনীতির মগজ বাড়ায়; ছাত্ররাজনীতি না থাকলে এ জিনিসটা হারাতে হবে । দেশের সম্মানজনক জায়গাগুলো পরবর্তী জীবনে তারা অলংকৃত করলে রাজনীতিতে একটি স্হিতিশীলতার নির্মল বাতাস নিয়ে আসবে; অন্যায়, দুর্নীতি, রাজনৈতিক অপচর্চা থেকে বাঁচাবে বাংলাদেশকে এবং দেশকে নিয়ে যাবে এতটা দূরে, যেখানে গেলে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয় না।
Comments